হিজরি বর্ষের তৃতীয় মাস রবিউল আওয়াল। যে মাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রিয়নবী (স.)-এর জন্ম ও মৃত্যুর ইতিহাস। এজন্য মাসটি মুসলিম উম্মাহর কাছে অত্যন্ত তাৎপর্যমণ্ডিত। ‘রবিউল আউয়াল’ শব্দের অর্থ বসন্তের শুরু বা প্রথম বসন্ত। এ মাসকে এ নামে নামকরণ করা হয়েছে বসন্তকালের শুরু লগ্ন হওয়ার কারণে। (রেসালায়ে নুজুম: ২২৯)
বিশ্বনবি হজরত মুহাম্মদ (স.) জন্মগ্রহণ করেছিলেন মক্কার শিবে বনু হাশিম-এ সুবহে সাদিকের সময়। সেদিন ছিল সোমবার। সহিহ সূত্রে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (স.) নিজেই জানিয়েছেন, তিনি সোমবার জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আবু কাতাদা আনসারি (রা.) বলেন,
سُئِلَ صلى الله عليه وسلم عَنْ صَوْمِ يَوْمِ الِاثْنَيْنِ قَالَ : ذَاكَ يَوْمٌ وُلِدْتُ فِيهِ ، وَيَوْمٌ بُعِثْتُ – أَوْ أُنْزِلَ عَلَيَّ فِيهِ
রাসুলকে (স.) প্রতি সোমবার রোজা রাখার কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, এ দিনে আমি জন্মগ্রহণ করেছি এবং এ দিনে আমাকে নবুওয়াত প্রদান করা হয়েছে অথবা এ দিনে আমার উপর ওহি অবতীর্ণ হয়েছে। (সহিহ মুসলিম: ১১৬২)
প্রসিদ্ধ মত অনুযায়ী দিনটি ছিলো রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ। এই মত পোষণ করেছেন তার সাহাবি ইবনে আব্বাস (রা.) ও জাবের (রা.)। নবিজির (স.) প্রথম জীবনীকার ইবনে ইসহাকের মতও এটি।
রাসুলের (স.) জন্মের সময় তার মা আমিনা দেখেছিলেন, তার সামনে এমন একটি জ্যোতি উদ্ভাসিত হয়েছে, যার আলোয় শামের রাজপ্রাসাদ পর্যন্ত আলোকিত হয়ে উঠেছে। ইরবাজ ইবনে সারিয়া থেকে বর্ণিত রাসুল (স.) বলেছেন,
إِنِّي عِنْدَ اللَّهِ مَكْتُوبٌ: خَاتَمُ النَّبِيِّينَ وَإِنَّ آدَمَ لِمُنْجَدِلٌ فِي طِينَتِهِ وَسَأُخْبِرُكُمْ بِأَوَّلِ أَمْرِي دَعْوَةُ إِبْرَاهِيمَ وَبِشَارَةُ عِيسَى وَرُؤْيَا أُمِّي الَّتِي رَأَتْ حِينَ وَضَعَتْنِي وَقَدْ خَرَجَ لَهَا نُورٌ أَضَاءَ لَهَا مِنْهُ قُصُورُ الشَّامِ
আল্লাহ তায়ালার কাছে আমি তখনো শেষ নবি হিসেবে লিপিবদ্ধ ছিলাম যখন আদম (আ.) মাটির সাথে মিশে ছিলেন। আমার নবুয়তের প্রথম প্রকাশ ঘটে ইবরাহিমের (আ.) দোয়া এবং ইসার (আ.) ভবিষ্যদ্বাণীর মাধ্যমে আর আমার মায়ের স্বপ্নে; তিনি আমাকে প্রসবকালে দেখেছিলেন, তার সামনে একটি জ্যোতি উদ্ভাসিত হয়েছে যার আলোয় সিরিয়ার রাজপ্রাসাদ পর্যন্ত আলোকিত হয়ে উঠেছে। (মুসনাদে আহমাদ: ১৭১৯১)
এ ছাড়া নবিজির (স.) জন্মের সময় কিসরার রাজপ্রাসাদের স্তম্ভ ধ্বসে পড়া, অগ্নিপূজকদের আগুন নিভে যাওয়াসহ কিছু অলৌকিক ঘটনা ঘটেছিলো বলে প্রসিদ্ধ থাকলেও এগুলোর নির্ভরযোগ্য কোনো সূত্র পাওয়া যায় না।
জন্মের পর নবজাতক মুহাম্মদকে (স.) দাদা আব্দুল মুত্তালিবের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি তাকে দেখে অত্যন্ত আনন্দিত হন। তাকে নিয়ে কাবায় প্রবেশ করেন, একটি দুম্বা জবাই করেন এবং তার নাম রাখেন ‘মুহাম্মদ’ অর্থাৎ প্রশংসিত।
নবিজির (স.) চাচারাও তার জন্মের খবরে অত্যন্ত আনন্দিত হন। যে দাসী নবিজির (স.) চাচা আবু লাহাবকে তার জন্মের সংবাদ দিয়েছিলো, তিনি তাকে মুক্ত করে দেন। তার নাম ছিল সুওয়াইবা। সুওয়াইবা রাসুলের (স.) প্রথম দুধ-মা; হালিমা সাদিয়ার (রা.) দায়িত্বে দেওয়ার আগ পর্যন্ত তিনিই রাসুলকে (সা.) দুধপান করান।
তাই রবিউল আউয়াল এলে মুমিন হৃদয়ে বারবার নাড়া দিয়ে যায় প্রিয়নবীর (স.) কথা। তাঁকে নিয়ে কবিতা রচনা করা হয়। বিভিন্ন প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও বই লেখা হয়। বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। মুসলিম বিশ্বের নানা প্রান্তে অনুষ্ঠিত হয় ঈদে মিলাদুন্নবী ও সিরাতুন্নবী (স.) মাহফিল। বিভিন্ন মুসলিম দেশে ১২ রবিউল আউয়াল সরকারিভাবে ছুটি ঘোষণা করা হয়।
বাংলাদেশেও স্বাধীনতার পর থেকে প্রতি ১২ রবিউল আউয়াল সরকারিভাবে ছুটির রেওয়াজ রয়েছে। এবার বাংলাদেশে পবিত্র ১২ রবিউল আউয়াল হবে ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩।
সবচেয়ে বড় কথা হলো, মহানবী (স.)-এর আদর্শের অনুসরণ কোনো বিশেষ দিনের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। তাঁর আদর্শ নিত্যদিনের জন্য। সব যুগের ও সবসময়ের জন্য। অন্য যেকোনো আদর্শ তাঁর আদর্শের সামনে গৌণ।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘যারা আল্লাহ ও শেষ বিচার দিবসের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্য আল্লাহর রাসুলের মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে।’ (সুরা আহজাব: ২১)
সুতরাং প্রতিটি ক্ষণে, প্রতিটি কাজে অনুকরণ অনুসরণ করার জন্য মহানবী (স.)-এর সুন্নাহ রয়েছে। রয়েছে তাঁর সুমহান আদর্শ। তাই সে মোতাবেক জীবন পরিচালনা করার মধ্যেই নবীপ্রেমের স্বার্থকতা লুক্কায়িত। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে মহানবীর (স.) সুন্নাহ মোতাবেক জীবন পরিচালনার তাওফিক দান করুন। আমিন।