নিজস্ব প্রতিবেদক |
প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে প্রায় তিন দশক ধরে কাজ করে চলেছে বান্দরবান জেলার লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের বোধিছড়াস্থ কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানটি বিবর্ণ পাহাড়ি এলাকাটিকে পরিকল্পিতভাবে প্রকৃতিবান্ধব এলাকায় রুপান্তরের পাশাপাশি সুবিধা বঞ্চিতদের লেখাপড়ার জন্য গড়ে তুলে কসমো স্কুল ও কলেজ। আবাসিক এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করছেন পাহাড়ের পিঁছিয়ে পড়া ৩ হাজার গরীব অসহায় ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি ও বাঙ্গালী শিশু। কিন্তু এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশে এবং ওই এলাকার সুপেয় পানির উৎস আন্ধারি খালের উৎপত্তিস্থলে রাবার প্রসেসিং ফ্যাক্টরি স্থাপনের উদ্যোগ নেয় লামা রাবার ইন্ড্রাসিট্রজ। এতে স্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিপর্যয়ের শঙ্কায় রয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীসহ স্থানীয়রা। শুধু তায় নয়, এর প্রভাবে অনাবাদি হয়ে পড়বে ১২০ একর তিন ফসলা জমি। তাই প্রস্তৃাবিত ফ্যাক্টরি জনমানবহীন এলাকায় স্থাপনের জোর দাবী তুলেন শিক্ষার্থী ও স্থানীয়রা।
জানা যায়, কোয়ান্টাম কসমো স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০১ সালে। এটি পার্বত্য অঞ্চলের একমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেখানের আড়াই শতাধিক শিক্ষার্থী এখন দেশের বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল এবং বুয়েটে অধ্যয়নরত। শুধু তায় নয়, লেখাপড়ার পাশাপাশি গত কয়েক বছর ধরে জাতীয় পর্যায়ের ক্রীড়া প্রতিযোগিতা এবং জাতীয় শিশু-কিশোর কুচকাওয়াজেও অনবদ্য সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে চলেছেন এ প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থী বাশৈচিং খিয়াং, হোসেন ত্রিপুরা, রাহাত হোসেন, বিশু সাওতাল, মেনলাং মুরুং ও জিতু ধরের অভিযোগ, ফ্যাক্টরি স্থাপনের মধ্যে দিয়ে রাবার প্রসেসিংয়ের কাজ শুরু হলে এর বর্জ্য আশপাশ ঝিরিতে, ঝিরি থেকে আবার সে বর্জ্য আন্দারী খালে পড়বে। চারদিকে দুর্গন্ধ ছড়াবে এবং শব্দ দূষণ হবে। এতে তারা স্বাস্থ্যগত ঝুঁকিতে পড়বেন। এছাড়া পাহাড়ের স্নিগ্ধ পরিবেশে লেখাপড়াসহ শারীরিক-মানসিক সুস্থতা নিয়ে এতদিন তারা যেভাবে বেড়ে উঠেছে, সেটি আর থাকবেনা।
সরেজমিন দেখা যায়, ফ্যাক্টরি নির্মাণের জন্য জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে, পাহাড়ের মাটি কেটে সমান করা হয়েছে। এর তিন পাশে রয়েছে আন্দারী খালের উৎপত্তিস্থলের ঝিরি। পাশেই রয়েছে জনবসতি, আবাসিক ও স্কুল ক্যাম্পাস। এ সময় কথা হয় কৃষক মো.কবির, মো. ফিরোজ, মো. খোকন, আবদুল মালেক সহ অনেকের সাথে। তারা অনতিবিলম্বে ফ্যাক্টরি অন্যত্র স্থাপনের জোর দাবি জানিয়ে বলেন, ফ্যাক্টরি নির্মাণের জন্য জমি ও পাহাড় কাটছে লামা রাবার ইন্ড্রাস্ট্রিজ কর্তৃপক্ষ। তারা আরও বলেন, প্রস্তাবিত রাবার প্রসেসিং ফ্যাক্টরি ওই এলাকা স্নিগ্ধ সতেজ পরিবেশের জন্য হয়ে উঠবে হুমকি। এ ছাড়াও আন্ধারী খালের উৎপত্তিস্থলে রাবার প্রসেসিং ফ্যাক্টরি হলে সুপেয় পানি দূষিত হয়ে পড়বে।
এ বিষয়ে সরই ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আব্দুল হালিমসহ পূর্ব ঢেকিছড়া ত্রিপুরা পাড়া কারবারী রুমতুই মুরুং ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের ১ হাজার ৬০০ একর জমি থাকতে কেন আন্ধারী খালের উৎসে ও কোয়ান্টাম কসমো স্কুলের পাশে এসে ফ্যাক্টরি বানাতে হবে? ফ্যাক্টরি অন্যত্র স্থাপন করা হউক। এখানে ফ্যাক্টরি করা হলে ১২০ একর জমি অনাবাদি হয়ে পড়বে। এছাড়া স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়বে কোয়ান্টাম আবাসিকের কোমলমতি শিক্ষার্থীরা।
এদিকে লামা উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. শোভন দত্ত জানায়, রাবার কারখানায় যে কেমিক্যাল করা হয়, তা মানবশরীর, ফসল, পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য ক্ষতিকর। এটি পানিকে দূষিত করে। এর প্রভাব সবখানে পড়বে। এ দূষণ দীর্ঘমেয়াদি হলে এ এলাকার মানুষ ক্যানসারেও আক্রান্ত হবে।
লামা রাবার ইন্ড্রাাস্ট্রিজের ম্যানেজার আরিফ হোসেন বলেন, সবেমাত্র রাবার প্রসেসিং ফ্যাক্টরি স্থাপনের অনুমতি চেয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরে আবেদন করেছি। এ প্রেক্ষিতে পরিবেশ অধিদপ্তরের একটি টিম স্থান পরিদর্শন করেছেন। অনুমতি পেলে ফ্যাক্টরি স্থাপন করা হবে। শিক্ষার্থী ও স্থানীয়দের অভিযোগের কোন ভিত্তি নেই বলেও জানান তিনি।
রাবার প্রসেসিং ফ্যাক্টরি পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে কিনা জানাতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তর বান্দরবানের সহকারী পরিচালক মো. রেজাউল করিম বলেন, রাবার প্রসেসিং ফ্যাক্টরি স্থাপনের বিষয়ে এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি বা অনুমোদন দেওয়া হয়নি। আমি এলাকা পরিদর্শন করেছি। বিশেষজ্ঞরাও পরিদর্শন করবেন, এরপর সবদিক বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।