কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার পাহাড় এখন স্থানীয় বাসিন্দা ও রোহিঙ্গাদের কাছে আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। টেকনাফ উপকূলে নতুন আতঙ্ক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে ‘অপহরণকাণ্ড’। মুক্তিপণ দিয়েও কেউ ফিরছে, কেউ লাশ হয়ে ফিরছে।
দুই সপ্তাহ আগে টেকনাফের দিনমজুর আব্দুল আলীর (ছদ্মনাম) কিশোর ছেলেকে অপহরণ করে পাহাড়ি এলাকায় আটকে রেখে নির্যাতন চালানো হয়। নির্যাতনের ভিডিও পাঠিয়ে মুক্তিপণ দাবি করে অপহরণকারীরা। ছেলেকে ফিরে পেতে আব্দুল আলী থানা-পুলিশের দ্বারে দ্বারে ঘুরেও কোনো সাড়া পাননি।
অবশেষে র্যাবের কাছে গেলে তারা জানায়, ক্যাম্পের ভেতরে যাওয়ার অনুমতি তাদের নেই। আব্দুল আলীর ভাষ্যমতে, “ঘর-ভিটা বন্ধক রেখে, পাড়ার মানুষের কাছ থেকে চাঁদা তুলে দুই লাখ টাকা জোগাড় করে অপহরণকারীদের হাতে হাতে দিয়ে ছেলেকে ফিরিয়ে এনেছি।” তার ছেলেও জানিয়েছে, অপহরণকারীরা সবাই রোহিঙ্গা।
স্থানীয়দের ভাষ্য, টেকনাফে এমন কোনো দিন নেই যেদিন অপহরণ বা মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনা না ঘটছে। একসময় ‘ক্রসফায়ারের’ লীলাভূমি এখন অপহরণের ‘স্বর্গরাজ্যে’ পরিণত হয়েছে। স্থানীয় অপরাধীদের সাথে রোহিঙ্গাদের যোগসাজশে এই অপহরণ বাণিজ্য চলছে।
রোহিঙ্গাদের অনেকগুলো গ্রুপ এতে সক্রিয়, যাদের শিকার হচ্ছেন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা ও স্থানীয় জনগণ। স্থানীয় সংবাদকর্মীদের হিসেবে, এক বছরে টেকনাফ উপজেলায় অন্তত ১৯৩ জন অপহরণের শিকার হয়েছেন। ৯১ জন স্থানীয় বাসিন্দা, বাকিরা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অপহৃতদের ‘উদ্ধারের’ দাবি করলেও ভুক্তভোগীদের পরিবার বলছে, অন্তত দেড়শ জন মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে এসেছে। এদের মধ্যে কৃষক, শ্রমিক, কাঠুরিয়া, বনকর্মী, অটোরিকশা ও টমটম চালক, শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী, পর্যটক, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের শিশু ও পুরুষরা রয়েছেন।
ভুক্তভোগীদের ভাষ্য, মুক্তিপণের টাকা নির্ধারিত হয় ভুক্তভোগী পরিবারের আর্থিক সংগতির ওপর। ক্যাম্পের লোক হলে সেখানকার বাসিন্দারা, আর বাইরের লোক হলে স্থানীয় সহযোগী অপরাধীরা অপহরণকারীদের তথ্য দেয়। সমঝোতার ভিত্তিতে মুক্তিপণের টাকা ১৫-২০ হাজার থেকে ১৪-১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত হয়।
টেকনাফ মডেল থানার ওসি মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন বলেন, তথ্য-প্রযুক্তির সহায়তায় অপহৃতদের অবস্থান জানার চেষ্টা করছে পুলিশ। গত এক বছরে ১৯টি মামলায় ২৯ অপহরণকারীকে আটক এবং অপহৃত ৬০ জনকে উদ্ধার করা হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও জনপ্রতিনিধিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, টেকনাফ উপজেলার হ্নীলা, হোয়াইক্যং ও বাহারছড়া ইউনিয়নে অপহরণের ঘটনা বেশি। বাহারছড়ার নোয়াখালীপাড়া, বড় ডেইল, মাথাভাঙা, জাহাজপুড়া, ভাগগুনা, মারিশবনিয়া, হোয়াই্যকংয়ের ঢালা, চৌকিদারপাড়া, দক্ষিণ শীলখালী গ্রামের মানুষ বেশি অপহরণ আতঙ্কের মধ্য থাকেন।
হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নূর আহমদ আনোয়ারী জানান, তার ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের অন্তত ৭০০ পরিবার অপহরণ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে। কিছু দিন আগেও এসব গ্রামের তিনজনকে অপহরণের পর হত্যা করা হয়।
ইউপি চেয়ারম্যান মনে করেন, পাহাড়ে অপহরণ রোধে সেনা অভিযান জরুরি।
বাহারছড়া ইউনিয়ন পরিষদের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ফরিদুল আলমের ভাষ্য, “আমার এলাকাটি এখন অপহরণের ‘হটস্পট’। এখান থেকেই শতাধিক মানুষ অপহরণের শিকার হয়েছে। সবাই মুক্তিপণ দিয়ে ফেরত এসেছে।”
মানবপাচার, মাদক ব্যবসা, অস্ত্র ব্যবসা, রোহিঙ্গাদের অপরাধ সংশ্লিষ্টতা, দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বিশাল জায়গায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর স্বল্পতা- এসব কারণে টেকনাফ অপহরণের ‘হটস্পট’ হয়ে উঠেছে বলে মনে করছেন কক্সবাজার জেলা পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জসীম উদ্দিন।
তার ভাষ্য, বছরের অন্য সময়ের তুলনায় ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে বেশি অপহরণের ঘটনা ঘটে, কারণ এই সময়টা শুষ্ক মৌসুম। দুর্গম পাহাড়ে অবস্থান ও চলাচলে সুবিধা হয়। ১ জানুয়ারি টেকনাফের জাদিমোড়া পাহাড়ে গাছ লাগাতে গিয়ে অপহৃত হন বনবিভাগের ১৮ কর্মী ও শ্রমিক।
অপহৃত সাইফুল ইসলাম বলেন, “গহীন পাহাড়ের একটি গুহায় নিয়ে আমাদের মোবাইল ফোন নিয়ে পরিবারের কাছে মুক্তিপণ দাবি করে। সারারাত পানি ছাড়া আর কিছু খেতে দেওয়া হয়নি। পরে ৩০ হাজার টাকা মুক্তিপণ নিয়ে আমাকে ছেড়ে দেয়। তাদের ব্যবহার, কথাবার্তা ও নির্যাতনের স্টাইল দেখে মনে হয়েছে তারা রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী।”
টেকনাফ বনবিভাগের রেঞ্জ কর্মকর্তা আবদুর রশিদ বলেন, “অপহরণের ভয়ে শ্রমিকরা কাজ করতে যেতে চাচ্ছেন না বনে। আপাতত অপহরণের ঝুঁকির কারণে ওই এলাকায় কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে।”
৩০ ডিসেম্বর অপহৃত হন বাহারছড়ার মুদি দোকানি জসীম উদ্দিন। নির্যাতনের ভিডিও ধারণ করে ৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণ চাওয়া হয়।
জসীমের ফুফাত ভাই ইউপি সদস্য ফরিদুর আলম জানান, “নিজের ঘর-ভিটা বিক্রি করে ১৫ লাখ টাকা সংগ্রহ করে অপহরণকারীদের মুক্তিপণ দেওয়া হয়। নয়দিনের মাথায় আমার মামাত ভাইকে সন্ত্রাসীরা ছেড়ে দেয়।”
২৮ এপ্রিল পাত্রী দেখতে টেকনাফে যাওয়ার পথে অপহৃত হন তিন বন্ধু। পরে দুর্গম পাহাড় থেকে তিনজনের গলিত লাশ উদ্ধার করা হয়। বিভিন্ন সময়ে ২০ লাখের অধিক রোহিঙ্গা কক্সবাজারের উপকূলে আশ্রয় নিয়েছেন। সরকারি হিসেবে, গত তিন-চার মাসে আরও প্রায় ৫০ থেকে ৬০ হাজার রোহিঙ্গা এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন।
স্থানীয় বাসিন্দারা শুরুতে রোহিঙ্গাদের স্বাগত জানালেও, রোহিঙ্গা সংখ্যাধিক্যের কারণে তারা এখন ‘সংখ্যালঘুতে’ পরিণত হয়েছেন। ক্যাম্পের বাইরে রোহিঙ্গাদের চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও সেটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। বাইরে রোহিঙ্গাদের চলাচল, কর্মসংস্থান, তাদের অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া- এসব কারণে স্থানীয়রাও এখন রোহিঙ্গাদের প্রতি ক্ষুব্ধ।
কক্সবাজার রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি মাহাবুবুর রহমান বলেন, “এখন রোহিঙ্গারা মাদক ব্যবসা, অপহরণ বাণিজ্য, অস্ত্র ব্যবসা থেকে শুরু করে গুম-খুনের মত বড় অপরাধে জড়িয়ে গেছে। বিশেষ করে অপহরণ বাণিজ্যে সরাসরি জড়িত রোহিঙ্গারা।”
সম্প্রতি এক অস্ত্রধারী রোহিঙ্গা যুবকের ছবি পাওয়া গেছে। মাঝিদের দাবি, অস্ত্রধারী ওই যুবকের নাম মোহাম্মদ শফি। নয়াপাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সি ব্লকের বাসিন্দা। তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলাও রয়েছে।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. মিজানুর রহমান বলেন, “আমাদের এজেন্সিগুলোকে বলেছি গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়াতে। এপিবিএনও কাজ করছে। রেজিস্ট্রার্ড মোবাইল নাম্বার না থাকায় অপরাধীদের শনাক্ত করতে বেগ পেতে হয়।”
১৬ এপিবিএন এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি মো. কায়সার শিকদার বলেন, তারা মূলত ক্যাম্পের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় কাজ করেন। অপহরণের সঙ্গে জড়িত চক্রগুলোর অবস্থান ক্যাম্পের বাইরের পাহাড়ে। ফলে সেই অভিযান চালানোর অনুমোদন তাদের নেই।
টেকনাফের দায়িত্বে থাকা র্যাব-১৫ এর স্কোয়াড্রন লিডার তৌহিদুল মবিন খান বলেন, তাদের কাছে তথ্য আছে, পাহাড়ে কয়েকটি সশস্ত্র ডাকাত গ্রুপ সক্রিয়। তাদের আস্তানা চিহ্নিত করার কাজ চলছে।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জসীম উদ্দিন বলেন, “এরই মধ্যে উপরমহল থেকে নির্দেশ এসেছে। শিগগিরই বিশেষ ফোর্স নিয়ে পাহাড়ে অভিযান শুরু হবে।” সূত্র-বিবার্তা ডটনেট